কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বয়স একেবারে কম নয়, চার দশক হতে চললো। এই দীর্ঘ সময়ে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনেক উন্নতি হয়েছে। মুদ্রণ শিল্প আধুনিক হয়েছে। ছাপা পত্রিকা ঝকঝকে রূপ পেয়েছে। অনলাইনে গণমাধ্যমগুলো পাঠককে চোখের আরাম দিয়েছে। কিন্তু কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না।
দেশে কম্পিউটারের প্রবেশ ঘটে ১৯৬৫ সালে। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। মানুষের প্রয়োজনে এক সময় কম্পিউটারে এসেছে বাংলা ভাষা। আবার ব্যবহারকারীরাই এর উন্নয়ন সাধন (ডেভেলপমেন্ট) করেছেন। ফলে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে প্রবেশ করে তা আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে।
কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলন হয় ৩৮ বছর আগে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ প্রকৌশলী সাইফুদ্দাহার শহীদ তার মাকে বাংলা ভাষায় কম্পিউটারে টাইপ করে একটি চিঠি লেখেন। দিনটা ছিল ২৫ জানুয়ারি। ফলে এই দিনটাকে অনেকে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলনের দিন মনে করেন।
সাইফুদ্দাহার শহীদ ম্যাকিন্টোশের যশোর ফন্ট এবং কি-বোর্ড লে-আউট শহীদলিপি বানিয়েছিলেন। সেটি পরে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটি ব্যবহার হয়েছিল। ম্যাকরাইট নামে বাংলায় সফটওয়্যার তৈরি করে পরবর্তী সময়ে তা ২-৩টি পত্রিকা ব্যবহার করেছিল। একই সময়ে হেমায়েত হোসেন নামের একজন বাংলা ফন্ট তৈরি করেন।
১৯৮৬ সালে মাইনুল ইসলাম তৈরি করেন মাইনুললিপি নামক একটি বাংলা ফন্ট। এর সুবিধা ছিল কোনো ড্রাইভার বা সফটওয়্যার ছাড়াই এ ফন্ট দিয়ে ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে সহজে বাংলা লেখা যেত। যুক্তাক্ষর সমস্যার জন্য তৈরি করা হয় চার লেয়ারের কি-বোর্ড।
জানা গেছে, অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল কম্পিউটারের জন্য একটি বাংলা ইন্টারফেস তৈরি করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ম্যাকিনটোশের বাংলা ফন্ট তৈরি করেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ইংরেজি বর্ণমালার অনুকরণে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের যেগুলো যুক্তাক্ষর তৈরি করে সেগুলোর একটি স্বাভাবিক মাপের আকৃতির পাশাপাশি একটি ছোট মাপের আকৃতি তৈরি করেন যুক্তাক্ষরের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহারের জন্য।
১৯৮৭ সালের ১৬ মে দেশে আসে বিজয় সফটওয়্যার। আর ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনন্দপত্র প্রকাশের মাধ্যমে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। এর উদ্ভাবক ও বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সে সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
তিনি জানান, এখন দেশের প্রায় শতভাগ কম্পিউটারে বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। আর ইন্টারনেট মাধ্যমে বিজয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সফটওয়্যার ব্যবহার হয়।
তিনি আরো জানান, বিজয় সফটওয়্যার এখন ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড। প্রথমে এটি করা হয় ২০০৪ সালে। ২০০৪ সালে প্রচলিত বিজয় কি-বোর্ডের দুটি বাটন পরিবর্তন বিডিএস-১৭৩৮-২০০৪ নামে একটি কি-বোর্ড স্ট্যান্ডার্ড করা হয়। ২০১৭ সালে মোবাইল ফোনের জন্য গঠিত একটি কমিটির প্রতিবেদনে ২০০৪ সালের বিডিএস-১৭৩৮-২০০৪ একই রেখে বিজয় কি-বোর্ডকে স্ট্যান্ডার্ড করা হয় বিডিএস-১৭৩৮-২০১৮ নামে।
মন্ত্রী জানান, একুশে বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয় তার প্রায় সবই বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে। খুবই সামান্য সংখ্যক বই প্রকাশিত হয় অন্যান্য সফটওয়্যার ব্যবহার করে। তিনি আরও জানান, মোবাইল ফোন অপারেটর রবির লোগোর ফন্ট তার তৈরি করে দেওয়া। গ্রামীণফোন যে ফন্ট ব্যবহার করে তাও তার তৈরি। তার কথাতেই জানা গেলো, বিজয় সফটওয়্যারে রয়েছে ১০৮টি ফন্ট। বৈচিত্র্যময় সব ফন্টই রয়েছে বিজয়ে।
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলনের প্রায় চার দশক হতে চললো কিন্তু এটা বিশেষভাবে এ দেশে পালিত হয় না। জাতীয়ভাবে এ ধরনের কোনও দিবস নেই। তাছাড়া এটা নিয়ে দেশে কোনও দিবস পালিত হয় বলেও শুনিনি।’
তবে ২০১১ ও ২০১২ সালের দিকে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে দিবস পালনের কথা শোনা গিয়েছিল। সাইফুদ্দাহার শহীদ যে তারিখে (২৫ জানুয়ারি) তার মাকে চিঠি লিখেছিলেন সেই তারিখটাকে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বা নেটিজেনরা পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এসবের পাশাপাশি ডা. মেহেদী হাসান খানের উদ্ভাবিত অভ্র বাংলা সফটওয়্যার বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। অনলাইনে লেখালেখি, স্মার্টফোনে বাংলা লেখার জন্য অভ্রও বিপুল জনপ্রিয়। সরকারি কাজে ব্যবহার হচ্ছে নিকশ ফন্ট। আরও রয়েছে সোনারবাংলা, রিদমিক, সোলায়মানলিপি ইত্যাদি।
পাঠকের মতামত